সানগ্লাস
অনেকদিন হলো নিজের পুরনো জায়গায় যাই নি| ছেলেবেলা কেটেছে যেখানে| যেখানে সারাদিন ধরে খেলে বেড়াতাম| ছুটে বেড়াতাম মাঠের মধ্যে| সেই মাঠের মাঝখানে একটা বিশাল গাছ ছিল| তাতে লাল রঙের ফুল ফুটত| আমরা গাছে চড়ে দোল খেতাম| এডাল থেকে ও ডালে লাফাতাম| লাল ফুল কুড়োতাম| লাল ফুল...
একটা ফকির এসে বসতো মাঝে মাঝে সেই গাছের তলায়| সাদা চুল ঝাকড়া ঝাকড়া, সাদা দাড়ি বুকের কাছে ঘন হয়ে শেষ হয়েছে, পুরনো ছেঁড়া কোট আর চোখের ওপর একটা ফাটা কাঁচের চশমা| চশমার কাঁচটা অবশ্য লাল| তখন তো সবাই লাল রঙেরই চশমা পরতো|
মাঝে মাঝে সেই ফকির গল্প বলতো| ভয়ংকর সব গল্প| মানুষের সমানাধিকারের গল্প| বিপ্লবের গল্প| রক্তের গল্প| ইতিহাসের গল্প| কোনো কোনদিন আমাদের খেলার মাঠের গল্প, এই গাছটার গল্পও বলতো| সেসব গল্প সত্যি না মিথ্যে জানি নে| তবে বিশ্বাস করতে ভালই লাগতো| একদিন তাকে জিগেস করেছিলাম “এই গাছে এত লাল ফুল কেন?” সে কিছুক্ষণ হাসলো নিজের মনে| তারপর তার গল্প বলেছিল|
এই গাছে নাকি আগে নানা রঙের ফুল হতো| তখন সবাই নানারঙের ফুল কুড়াত| কখনো কমলা, কখনো নীল, কখনো সাদা, কখনো হলুদ| একবার রাজামশাই এসে দেখলো নানা রঙের ফুল| রাজামশাইয়ের চোখে নীল চশমা| নীল চশমা দিয়ে অন্য রং দেখতে ভালো লাগে না| গাছে অনেক রঙের ফুল ফুটবে! এ কি বেয়াদপি| হুকুম ছুটলো, কাট গাছখানা| রাজপেয়াদা ছুটে এলো| কুড়ুল দিয়ে কাটা হলো গাছ| নতুন গাছ লাগানো হলো| নীল রঙের ফুল হয় নতুন গাছে| তারপর অনেক রাজা এলো| অনেক রাজা গেলো| এক একটা রাজা এক এক রঙের চশমা পরে| আর দেশসুদ্ধু লোক নিজের চশমার রং রাজার রঙে করার জন্য দৌড়তে থাকে| আর মাঝে মাঝেই গাছ কাটা যায়| এভাবে নতুন গাছে নতুন রঙের ফুল ফোটে| নতুন করে ছেলেরা নিজেদের ছোটবেলায় নতুন রঙের ফুল কুড়ায়| নতুন করে অনেকের ছোটবেলা কাটা যায়| গাছের সাথে মিশে থাকা অনুভূতিগুলো কাটা যায়|
গল্পটা বিশ্বাস করিনি| এত বড় গাছ| তাকে কাটা যায় নাকি? বুড়ো ফকিরকে বলেছিলাম, “কিন্তু ফুলের রং সত্যি বদলে যায় নাকি?” ফকির, নিজের লালচশমার ফাটা কাঁচটা মুছে শুধুই হেসেছিল| আজ আবার ইচ্ছে হলো মাঠে গিয়ে কিছু লাল রঙের ফুল কুড়াবো|
মাঠে গিয়ে দেখি অনেকগুলো লোক ঢাল তরোয়াল গাইতি নিয়ে গাছ কাটছে| তাদের চোখে কমলা চশমা| আমি ছুটে গিয়ে বলি, “একই গাছটা কাটছো কেন?” একটা কমলা চশমা বললো “কে রে তুই? তর চশমার রং কী?” আমি বললাম,” তা তো জানি না, আমি জানি এই গাছে লাল ফুল ফুটত”| হা হা করে হেসে কে বললো “তাহলে তুই লাল চশমা, মানে তুই হলি গিয়ে মুর্খ”| আমি বোকা বোকা মুখে তাকাতে কে একজন বললো “এ গাছে কোনোদিন লাল ফুল ফোটে নি, কমলা ফুল ফুটতো চিরকাল| তোরা দেখতে পাসনি|” আমি বললাম “তা হবে হয়তো| কিন্তু গাছটা কাটছে কেন? কমলা ফুল ফুটলে কমলা ফুলই ফুটুক, আমরা না হয় লাল দেখবো| কিন্তু গাছখানা কাটা কেন?” ওরা কিছুক্ষণ ভাবলো ব্যাপারটা নিয়ে| সত্যিই তো গাছ কাটার কি দরকার? কিন্তু তারপরেই ওরা সবাই একসাথে রে রে করে তেড়ে এলো| কেউ বললো “দে ব্যাটাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে”| কে বললো “এ ব্যাটা দালালি করে”| কেউ আবার তরোয়াল উচিয়ে বললো “ব্যাটা দেশদ্রোহী, মাথাটা কাট”| মুরুব্বিমতো কে একজন বললো “ অমুক রাজা গাছ কেটেছে, তমুক রাজা গাছ কেটেছে, তখন তোরা কোথায় ছিলি? আমরা কাটলেই গায়ে জ্বালা হয় না রে তোদের?” আমি বললুম “সে তো অনেকযুগ আগের কথা... ফকির বলেছিলো, শুনে তখনো গায়ে জ্বালা করেছিল”| ফকিরের নাম শুনে আবার সবাই তেড়ে এলো কমলা চশমা পরে| “সেই ফকিরের কথা বলছিস, এত সাহস তোর? ফকিরের সব গল্প ঝুটা, ও ষড়যন্ত্র করে সবাইকে ভুল গল্প বলে বেড়াত| আর দেখ দেখ, এ ব্যাটার চশমার রংটাই ভুল| যাই দেখে অন্য রঙের দেখে| আসল রংটাই চিনলো না|”
আমি কথা বাড়ালাম না| দেখছি গাছের ওপর কুড়ুল পড়ছে| হয়তো কাটা পড়বে গাছটা| আবার....
গাছের ফুলের আসল রংটা যে কী তা কেউ জানে না| সবাই চশমা পরে দেখে| হঠাত মনে পড়ল গাছের ওপর অনেকগুলো পাখির বাসা ছিল| পাখিদের কি হয় আমরা জানি না|
আমি গাছ ছেড়ে নিজের নতুন জায়গায় ফিরে চললাম| আমার চোখেও চশমা| চশমাটা পরে থাকলে দুনিয়াটা একটু অন্যরকম লাগে বটে| নিজের চশমার কাঁচের রং কী তা আমি জানি না| অনেকদিন হলো আমরা সবাই রং-কানা হয়ে গেছি| রং চিনতে খুব কষ্ট হয়|
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Kichhu rong ekhono alo khujchhe ... tumio nijer ichchemoto tader niye diye jete paro tulir elomelo koyekta taan ...