ছেঁড়া ইতিহাস - ৩
ম্যাকলিড সাহেবের ট্রেনের গল্প লিখে অনেক বাহবা কুড়োলাম| তাই 'বার' খেয়ে বেহালা নিয়ে আবার লিখছি

ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম এ জায়গাটার নাম বেহালা কেন? বেহালা একটা বাদ্যযন্ত্রের নাম, ভি জি যোগ কিংবা এল শংকরের বাজানো বেহালার করুণ সুরে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে| কিন্তু খামোখা একটা কোলাহলমুখর জ্যান্ত শহরতলির নাম বেহালা রাখার কোনো মানে হয়! বেহালা চির-উন্নয়নশীল দেশ| এই দেখা গেলো রাস্তাজুড়ে তারাতলার ফ্লাইওভার হয় তো তারপরেই গোটা বেহালার রাস্তা কেটে আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন| সেসব কাটাছেঁড়া শেষ হতে না হতেই মেট্রো| একটা উন্নয়নের ধাক্কা সামলে যে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেব, সে উপায় নেই বেহালাবাসীর| তাই ছোটবেলা থেকেই দেখছি এ জায়গাটার বড় বেহাল দশা| বহুদিন পর্যন্ত আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল “বেহাল” থেকেই জায়গাটার নাম হয়েছে বেহালা|
বেহালা জায়গাটার অস্তিত্ব কলকাতা শহরের অনেক আগে থেকে রয়েছে| কতদিন আগে? তা ধরুন আজ থেকে আটশ’ বছর আগের কথা| লখিন্দরের শবদেহ নিয়ে বেহুলার ভেলা গাঙুড় নদী দিয়ে ভেসে গিয়েছিল সাগরের পথে| সে যুগে নদীগুলোর গতিপথ ছিল অন্যরকম| এখনকার হুগলি নদীর গতিপথ তখন এইরকম ছিল না| আদিগঙ্গা বলে আমরা এখন যাকে চিনি, সেই খাতটি দিয়ে বয়ে যেত পতিতোদ্ধারিনী বিশাল গঙ্গা নদী| আদিগঙ্গা কলকাতার কাছে একটা বাঁক নিয়ে চিত্পুর, বেতড়, কালিঘাট, বারুইপুর হয়ে গঙ্গাসাগরে গিয়ে মিশতো| শোনা যায় বেহুলার ভেলা আদিগঙ্গা দিয়ে ভাসতে ভাসতে এসে থেমেছিল এক ঘাটে| সে ঘাটের নাম হয়ে যায় “বেহুলার ঘাট”| কালক্রমে বেহুলার ঘাট লোকমুখে হয়ে যায় “বেহালা”| এটা মোটামুটিভাবে বারশ’ শতকের কথা| পালরাজাদের রাজত্ব চলছে বাংলায়| এসময়েই লেখা হয় মনসামঙ্গল কাব্য| তারও আগে থেকে আরো অন্তত বহু বছর ধরে মুখে মুখে ফেরা মানুষের গান হয়ে বেঁচে ছিল মঙ্গলকাব্যগুলি|
এই সময়, অর্থাত বারো’শ শতকে বেহালা ছিল সুন্দরবনের অংশ| তখন এই অঞ্চলে বাস করত প্রচুর জেলে এবং মধুকর| এদের জমিদার ছিলেন এক কুলীন কায়স্থ, নাম ধনঞ্জয় মিত্র| বেহালার প্রথম শাসক বা নেতা হিসেবে তাঁর নামই পাওয়া যায়| তিনি ছিলেন চন্ডীর উপাসক| দেবী চন্ডীর আর একনাম বহুলা| অনেক গবেষকের মতে বহুলা দেবীর নাম থেকে জায়গার নাম হয় বেহালা| কালিঘাট (তখন নাম ছিল কালীক্ষেত্র বা কালিপীঠ) আর গঙ্গাসাগরের পথে পুন্যলোভাতুরা তীর্থযাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকতো| নদীপথে বানিজ্যের একটা বড় সুবিধা ছিল| ফলে স্বাভাবিক কারণেই এই অঞ্চলটি ধীরে ধীরে বর্ধিষ্ণু হতে থাকে| ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠে একটা জমজমাট অঞ্চল| কলকাতা শহর তো দুরের কথা, জব চার্নকের দাদু-ঠাকুর্দাও তখনো সূর্যের আলো দেখেন নি| এসময়ে বেহালা ছিল অনেকগুলো ছোটো ছোটো গ্রাম নিয়ে তৈরী একটা জনপদ| প্রতিটি গ্রামের নামের শেষে -বেহালা কথাটা জোড়া থাকতো| যেমন বাজারবেহালা, বোঁড়শেবেহালা (বড়িশা), সরশুনোবেহালা (সরশুনা) ইত্যাদি। এমনকি পুরসভার নথিপত্রেও রাজারবাগানবেহালা, সাহাপুরবেহালা, নস্করপুরবেহালা, সন্তোষবাটিবেহালা এইসব নামের উল্লেখ পাওয়া যায়|
পঞ্চদশ শতকে বারো ভূইয়াঁর একজন ছিলেন বসন্ত রায়| তাঁর রাজধানী ছিল সরশুনোবেহালা| সরশুনোর ইতিহাস সম্ভবত আরো বেশ কয়েকশো বছর আগেকার| গ্রীক পন্ডিত টলেমির (১০০-১৭০ সাল) আঁকা ইন্ডিয়ার ম্যাপে “বেসিন সালসুনো” খুঁজে পাওয়া যায়| বহু পুরোনো পুঁথিপত্রে সরশুনো, রায়গড় এইসব জায়গার উল্লেখ আছে| বসন্ত রায়কে হত্যা করে বেহালা সহ চব্বিশ পরগনা দখল করেন যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য| দিল্লির মসনদে তখন সম্রাট আকবর| আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ যশোররাজ প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করেন| সেই যুদ্ধে মুঘল সেনাপতিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন এক বঙ্গসন্তান| তাঁর নাম লক্ষীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়| ইতিমধ্যে আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীরের আদেশে রাজা মানসিংহ ১৬০৮ সালে চব্বিশ পরগনা, বাংলাদেশ এবং মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জায়গীরদারি দেন লক্ষীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়কে| লক্ষীকান্ত এসময় রায়চৌধুরী উপাধি পেয়েছিলেন| তাঁর রাজধানী ছিল বড়িশা বা বোঁড়শেবেহালা| তিনিই সম্ভবত বাংলাদেশে প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেন| এই লক্ষীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়েরই উত্তরপুরুষ হলেন বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার| আর এইসব ঘটনার প্রায় একশো বছর পর তৈরী হওয়া কলকাতা শহরের ইতিহাসে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কথা কে না জানে?
রেফারেন্স:
http://www.sabarna.faithweb.com/
http://bongodorshon.blogspot.in
http://worldebookfair.com/articles/eng/Behala
https://en.wikipedia.org/wiki/Behala
http://sarsunacollege.ac.in/?page_id=251
http://www.sabarna.faithweb.com/
http://bongodorshon.blogspot.in
http://worldebookfair.com/articles/eng/Behala
https://en.wikipedia.org/wiki/Behala
http://sarsunacollege.ac.in/?page_id=251
আবেদন: সুধীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘বেহালা জনপদের ইতিহাস’ (প্রগ্রেসিভ রাইটার্স গিল্ড) বইটির কোনো প্রিন্ট কারুর কাছে থাকলে, পড়তে দিলে বাধিত হব| যথাসময়ে বই ফেরত দেবার এবং পাতা না মুড়ে পড়ার সুখ্যাতি রয়েছে|
-- সৌম্য মাইতি
-- সৌম্য মাইতি
ছেঁড়া ইতিহাস - ২
ছেঁড়া ইতিহাস - ১
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Kichhu rong ekhono alo khujchhe ... tumio nijer ichchemoto tader niye diye jete paro tulir elomelo koyekta taan ...