ছেঁড়া ইতিহাস - ২

বেহালায় বাড়ি আমার| ছোটোবেলা থেকে শুনে এসেছি অনেকেই জেমস লং সরনীকে রেললাইন বলতেন| উত্তর থেকে দক্ষিণে কলকাতা শহরের বুক চিরে চলে গেছে ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১৭, যাকে সবাই ডায়মন্ড হারবার রোড নাম চেনেন| ডায়মন্ড হারবার রোডের সমান্তরাল চলে গেছে শহরের ব্যস্ততম রাস্তাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই জেমস লং সরণী| রিক্সাচালক, অটোচালক বা স্থানীয় লোকজন খামোখা একটা আস্ত রাস্তাকে রেললাইন কেন বলতেন আমার মাথায় ঢুকত না| ভাবতাম সত্যি বুঝি ট্রেন চলে এখানে| কিন্তু বিশ বছরেও এই রাস্তার ধরে কাছে কোনো ট্রেন দেখিনি|

কিন্তু ট্রেন চলতো বটে এককালে| এই রাস্তা তখন ছিল ন্যারো গেজ রেল লাইন| "কু ঝিক ঝিক" শব্দ করে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলে যেত কয়লার ইঞ্জিন| কালীঘাট থেকে ফলতা পর্যন্ত এই রেললাইনটি চালাতো ম্যাক্লয়েড লাইট রেলওয়েজ কোম্পানি| লোকে বলতো ম্যাকলিড সাহেবের ট্রেন| তা সেই ম্যাকলিড সাহেবের কোম্পানিই ১৯১৭-র ২৮ মে তারিখে প্রথম কলকাতার বুকে এই রেলগাড়ি চালাতে শুরু করে। রেল চলত কালীঘাট থেকে ফলতা পর্যন্ত। কালীঘাট স্টেশন বলে কোনো স্টেশন ছিলনা| মাঝেরহাট পর্যন্ত এসে ট্রেন নামিয়ে দিতো যাত্রীদের| সেখান থেকে পায়ে হেঁটে লোকে যেত কালীঘাটের মন্দিরে পুজো দিতে| ইংরেজরা এই ট্রেনের নাম দিয়েছিলো কালীঘাট-ফলতা রেলয়েজ, সংক্ষেপে কেএফআর| প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধের রসদ পরিবহনের জন্য তড়িঘড়ি করে ইংরেজরা মিশরের ডেল্টা রেলওয়েত্র চালাবে বলে অনেকগুলো লাইটওয়েট রেলইঞ্জিন বানায়| সেগুলোর প্রয়োজন ফুরোয় যুদ্ধ শেষের আগেই| কাজেই ব্যবহার না হওয়া রেলইঞ্জিনগুলো চলে আসে ইন্ডিয়াতে| তারই একটা মাত্র ইঞ্জিন দিয়েই তৈরী হয় কেএফআর| লাইটওয়েট ইঞ্জিন বলে এই ট্রেন খুব ধীর গতিতে পাড়ি দিতো 43 কিলোমিটার রাস্তা| দিনে দুটো মাত্র গাড়ি| লোকজনের বাড়ির উঠোনের সামনে দিয়ে চলে যেত সেই রেলগাড়ি| তখন রেললাইনের কাছে কারুর বাড়ি থেকে ডাক দিলেই দাঁড়িয়ে যেত ম্যাকলিড সাহেবের গাড়ি। গাড়ি থামিয়ে তুলে দেওয়া যেত কলাটা মূলোটা কিংবা পুকুরের মাছ| শহর থেকে রেল চালিয়ে খবর নিয়ে আসার রেওয়াজও ছিল সে সময়ে।অনেকেই মাঝেরহাট স্টেশনে এসে ড্রাইভারকে বলে দিতো বাড়িতে খবর দেওয়ার কথা| ড্রাইভার ট্রেন চালাতে চালাতে হঠাত পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীকে ডেকে বলতো "পোড়াঅশ্বত্থতলার বাঁড়ুজ্জ্যে মশাইকে বলে দিও হে কলকাতায় ওনার নাতি হইছে"| শোনা যায় এক বুড়ি রেললাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো, ড্রাইভার বললো "ও বুড়িমা, যাও কোথা? টেরেনে উঠে পড় গো"| বুড়ি বললে "না বাবা, আজ আমার এট্টু তাড়া আছে, পায়ে হেঁটেই যাই"| সেই রেলইঞ্জিন এখন লন্ডনের রেল মিউজিয়ামে রাখা আছে, কেএফআর লেখাটুকু আজও অমলিন|

তবে ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৫৭ সালে ম্যাকলিড সাহেবের কোম্পানি এদেশ থেকে পাততাড়ি গোটায়। তার সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যায় সেই ঝমাঝম শব্দ। তৈরি হয় নয়া রাস্তা। ১৮৬১ সালে, দীনবন্ধু মিত্রর লেখা নীলদর্পন নিষিদ্ধ করেছেন ইংরেজ সরকার| এরই মধ্যে সেই নাটকটিকে ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করা হয় অনুবাদকের নাম ছাড়াই| বইয়ের স্বত্ব কিনেছিলেন পাদরী জেমস লং| আদালতে তিনি সেই অনুবাদকের নাম কিছুতেই প্রকাশ করলেন না| শাস্তি হলো তাঁর| হাজার টাকা জরিমানা এবং কারাবাস| হাসিমুখে মেনে নিলেন সাহেব, কিন্তু একবারও বলতে রাজি হলেন না সেই নেটিভের নাম যে এরকম একটা নিষিদ্ধ বই অনুবাদ করেছেন (প্রসঙ্গত সেই নামটি ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্ত)| সেই জেমস লং সাহেবের নামে নামকরণ হলো রাস্তার| সময়ের রেলগাড়ি হয়তো ঝমঝম শব্দে চলে গিয়েছে অনেক দূরে। ইতিহাসের লেন্স ছাড়া শত চেষ্টাতেও তাকে আর দেখা যাবে না। কংক্রিটের রাস্তায় কান পাতলে হয়তো আজও শোনা যাবে “ও ডেরাইভার সাহেব, এট্টু কান দাওনাগো ইদিকে। মায়ের থানে পোসাদ চরাব গা”। তিনশ বছরের এই শহরের স্মৃতিতে আজও সেই রেললাইন পাড়ি দেয়, বেহালাতে যেকোনো জায়গা থেকে রিক্সায় উঠে রেললাইন বললে বিনা প্রশ্নে পৌঁছে যাবেন জেমস লং সরণী|ছেঁড়া ইতিহাস - ১ 

মন্তব্যসমূহ

ফলতার ইতিহাস নিয়ে কাজ করছি
ফলতা রেলপথ নিয়ে বিভুতিভূষন মুখোপাধ্যায়ের লেখা দুয়ার হতে অদূরে উপন্যাসটি ফলতার কথা এবং আমার লেখা দেবিপুর থানা আজকের ফলতাথানা

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

tukro shorot-1

কুঁচো-কাঁচা দুঃখকথা......

pajore somudrer dheu .....